টাঙ্গাইলে দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি

1161

আগেই সাজ্জাদুর রাশেদ ভাই বলে দিয়েছিলেন, দেলদুয়ার জমিদার বাড়িতে ঢুকার সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর টোপকে ঢুকে যাওয়া। একজন কেয়ারটেকার আছে, তবে সে অধিকাংশ সময় থাকে না বা থাকলেও ঢুকতে দেয় না। তাই পৌছেই বেশ হাচরে-পাঁচরে এ জমিদার বাড়ির প্রাচীর পার হতে হল। ভেতরে আসলেই কেউ নেই, গা ছমছমে একটা ব্যাপার আছে। বাড়ির সামনের দিকে পারিবারিক কবরস্থানটি সে ছমছমে ভাবে অধিমাত্রা দিয়েছে। দেলদুয়ার জমিদার বাড়ির নাম নর্থ হাউস। জমিদার বাড়ির সীমানার পূর্বদিকে বিশাল কড়ই গাছ। গাছের নিচে আজও সেই আদি বসার ব্যবস্থা। লোহার গার্ডেন চেয়ার, গোল টেবিল, একপাশে কৃত্রিম পানির ফোয়ারা। বাড়ির সামনের দিকে কবরস্থানের ধারণা সম্ভবত, পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছে, কেমন যেন হঠাৎ করে মূল বাড়ির কিছুটা অংশ জুড়ে আছে বলে মনে হয়। প্রাচীরটিও খুব বেশি পুরাতন নয়। বাড়ির মেইন্টেনেন্স এখনো আছে। সামনের বাগান সে স্বাক্ষরই দেয়। পেছনে বেশ যায়গা নিয়ে আম বাগান। বাগানের মাঝে টালির দোচালা শেড। শেডের ফ্লোর ও পিলারের কারুকাজ দেখে মনে হয় বেশ সখ করে বানান হয়েছিল। একসময় বাড়ির মহিলা সদস্যদের আড্ডাস্থান হিসেবে ব্যবহƒত হলে বলে মনে হয়। এখন সম্ভবত, সন্ধ্যাকালীন পার্টীতে এই শেডটি ব্যবহƒত হয়। ঔপনিবেশিক স্থ্যাপত্য শৈলীতে নির্মিত দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি এখনও বেশ ভালো অবস্থায় আছে। জমিদার বাড়ির পূর্ব-দক্ষিন কোনে দারুণ নান্দনিক মসজিদ। এক সময়ে মূল রাস্তা থেকে জমিদার বাড়ি পর্যন্ত নিজস্ব রাস্তা ছিল, সে রাস্তা এখন হাটে যাওয়ার জন্য সকলের জন্য উন্মুক্ত। রাস্তার দু’পাশে আজও প্রবেশ তোরণ সাক্ষী হিসেবে অটুট আছে। দেলদুয়ার জমিদার বংশ :দেলদুয়ারের জমিদাররা জনদরদী ও দানবীর হিসেবে পরিচিত। জমিদাররা নামের শেষে গজনভি পদবী ব্যবহার করেন। এ বংশের পূর্বপুরুষরা আফগানিস্তানের গজনি থেকে এসেছিলেন দেখে নামের শেষে এ পদ অলংকার। ফতেহদাদ খান গজনভি লোহানি থেকে এ জমিদার বংশের পত্তন হয়েছে। এই জমিদার বংশের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি দ্বয় হচ্ছে স্যার আবদুল করিম গজনভি ও স্যার আবদুল হালিম গজনভি। এ ভাত্রিদ্বয় আবদুল হাকিম খান গজনভি এবং করিমুন নেসা খানম চৌধুরানীর সন্তান। করিমুন নেসা খানম চৌধুরানী ছিলেন বেগম রোকেয়ার বোন। স্যার আবদুল করিম গজনভি (১৮৭২-১৯৩৯ইং) : পড়াশুনা করেছেন ইংল্যান্ডের ডেভনশাযারের এক্সমাউথের সেন্ট পিটার্স স্কুল, লন্ডনের মেসার্স রেন এন্ড গার্নেজ ইনস্টিটিউশন, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জার্মানির জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবদুল করিম গজনভি ১৮৯৪ সালে পিতার জমিদারি এস্টেট পরিচালনার কাজ শুরু করেন। তিনি দুইবার মন্ত্রি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন (১৯২৪ ও ১৯২৭ সাল)। তিনি ১৯২৮ সালে নাইট ও ১৯৩৩ সালে নবাব বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি ৩টি বই লিখেছেন ঃ ১ পিলগ্রিম ট্রাফিক টু হেজাজ এন্ড প্যালেস্টাইন,২ মুসলিম এডুকেশন ইন বেঙ্গল ও৩ দ্য ডাইয়ারকিয়াল সিস্টেম ইন বেঙ্গল। স্যার আবদুল হালিম গজনভি (১৮৭৬-১৯৫৩ইং) : স্যার আবদুল হালিম গজনভি-স্যার আবদুল করিম গজনভির ছোট ভাই। তিনি একই সাথে রাজনীতিবিদ ও সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি যথাক্রমে কলকাতার মুসলিম চেম্বার অব কমার্স (১৯৩৯-১৯৪০) ও ইন্ডিয়া চেম্বার অব কমার্সের (১৯৪৫-১৯৪৬) সভাপতি ছিলেন। তিনি ইন্ডিয়া স্টিমশিপ কোম্পানির চেযারম্যান হিসেবেও দাযত্বিপালন করেছেন। তিনি দি মুসলমান ও দ্য স্টার অব ইন্ডিয়া পত্রিকা প্রকাশের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি নাইট খেতাব পান। এই ডাকসাইটের ব্যবসায়ী, জীবনের শেষ ৪ বছর দেলদুয়ার জমিদার বাড়িতে কাটিয়েছিলেন।