জেলায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপন
“নারী-কন্যার সুরক্ষা করি, সহিংসতা মুক্ত বিশ্ব গড়ি” এই প্রতিপাদ্যে- জেলায় আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস- ২০২৪ উদযাপিত হয়েছে। আজ সকালে এ উপলক্ষ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আয়োজনে, “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” কার্যক্রমের আওতায়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার জয়িতাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাহিদা আক্তারের সভাপতিত্বে, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুস সামাদ। সভার শুরুতেই কোরআন থেকে তেলাওয়াত ও গীতা পাঠ করা হয়। পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ জয়ীতারা তাদের জীবন যুদ্ধের কথা তুলে ধরেন। এসময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ বলেন, আসলে আজকের এই অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হচ্ছেন আমাদের সম্মানিত জয়ীতারা। আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আজকের জয়ীতাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা ৫টি ক্যাটাগরিতে ৭জন জয়ীতাকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত করা হয়েছে। আপনাদেরকে এই সম্মাননা সংবর্ধনা দিতে পেরে আমরা গর্বিত, এটা আমাদের জন্য খুবই ভালো লাগার বিষয় যে, এই একটি আয়োজনের মাধ্যমে আমরা এই সংবর্ধনা দিতে পেরেছি। আর আমরা যে ৭ জন জয়ীতার জীবন কাহিনী শুনলাম, শত প্রতিকূলতার মাঝেও তারা থেমে যাননি। অনেকসময় সময় পরিবার সাপোর্ট করেনি, অনেক সময় সমাজ সাপোর্ট করেনি, অনেকের কাছের লোকজন তাদেরকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, কেউ আবার নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন তিনি একজন সফল বউ থেকে এখন এখানকার মেয়ে হযে গেছেন। আমাদের আরেকজন যে সমাজের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মেয়ে সেখান থেকে তিনি সাবলম্বী হয়েছেন। আমরা এখন এমন অনকেইে আছি যারা সমাজের সুবিধা প্রাপ্ত কিংবা সুবিধাভোগী। কিন্তু আজকে যাদের জীবন কাহিনী আমরা শুনলাম প্রকৃতপক্ষে সফল নারী কিংবা সফল মানুষ যদি আমরা বলি, তাহলে উনারাই প্রকৃত অর্থে সফল মানুষ। সুবিধাভোগীদের চেয়ে যারা অনগ্রসর এবং সুবিধাবঞ্চিত অবস্থায় আজকে এখানে একত্রিত হয়েছেন এবং আরও যারা নিজেকে প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত আছেন, তারাই প্রকৃত অর্থে সফল মানুষ। এখন নারী নির্যাতিত হয়ে আসছে বলেই কিন্তু এই আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতিত প্রতিরোধ পক্ষ পালন করা হয়। যখন একটি পরিবারে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করেন তখন তার কোনো লৈঙ্গিক ব্যাখ্যা থাকেনা, তখন তার একটিই মাত্র পরিচয় থাকে, সে একজন মানুষ। কে মেয়ে কে ছেলে এই বৈষম্য মনোবৃত্তি আমাদের পরিহার করতে হবে। আপনারা আপনাদের নিজের জীবন থেকে দেখছেন, বুঝছেন। তাই আপনাদেরও উচিত এই বৈষম্য দূর করার কাজে সকলকে সচেতন করা। কারণ নিজে যখন বঞ্চনার শিকার হওয়া যায় তখনই বোঝা যায় কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত হবার কষ্ট কতটা। আমরা সকলেই যদি আমাদের মেয়ে বাচ্চাদের তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিই, তাহলে তারাও একটা ভালো জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। তারা এভারেস্ট শৃঙ্গও জয় করেছে। তাই সবই সম্ভব, শুধু তাদেরকে সুযোগ দিতে হবে। আমদের মেয়েদেরকে যদি আমরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি, যেটা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটি বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলেই আমাদের সমাজ এগিয়ে যাবে। অর্ধেকের বেশী এই জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ¯্রােতোধারায় আনতে না পারলে কখনোই কিন্তু আমরা আমাদের দেশের ও জাতির কাক্সিক্ষত উন্নয়ন করতে পারবোনা। এর জন্য অহেলিত মেয়েদেরকেও নিজে থেকে সর্বসম্মুখে এগিয়ে আসতে হবে। আজকের এই জয়ীতারা আমাদের নারী সমাজের জন্য বিরাট উদাহরণ ও অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এদিকে, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, পুলিশ সুপার-বিপিএম-সেবা মো: রেজাউল করিম। তিনি তার বক্তব্যে আজকের যারা জয়ীতা হয়েছেন তাদের জীবনের পুরো কাহিনী, তাদের এই জয়ীতা হবার আগে জীবনের চরাই-উৎরাইয়ের যে কাহিনী সেগুলো পুরোটাই শুনতে পারলে সবথেকে বেশী ভালো হতো। যাদের কথা শুনলাম তারা যে কষ্ট করেছে, যে অবহেলার শিকার হয়েছেন, সেই গল্পটার পেছনে কতটা আত্ম-হাহাকার থাকলে আজ সেই কথাগুলো বলতে গিয়ে তাদের চোখে পানি চলে আসে। আর সেটা কতচা হৃদয় বিদারক সেটা আজ তাদের চোখের পানির মাধ্যমেই প্রকাশ পেলো। যেকোনো যুদ্ধের জয় বা কেষ্টের বিনিময়ে সফলতা পাওয়া যায়, সেই যুদ্ধ জয় এবং সফলতার কথাটা বলতে পারাটা অনেকটা লম্বা একটা সময়ের ব্যাপার। তাদের কাছে থেকে আমাদেরও অনেক কিছু শেখার আছে। আজকে আরা এখানে যে কান্না দেখেছি, এর পেছনে কারণ হলো তিনি তার চোখের সামনে যে কষ্ট টা দেখেছে সেটা বলতে গিয়ে চোখের সামনে সেই দৃশ্যগুলো ভেসে উঠেছে। তাই বলবো, আপনারাও কখনো কোনো কাজে হাল ছেড়ে দিবেন না। দেখবেন জয় আপনাদের নিশ্চিত হবেই। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. নাকিব হোসেন তরফদার, সিভিল সার্জন ডা: এসএম মাহমুদুর রশিদ। জয়ীতা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন, জেলা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সিনিয়র অফিসার গ্লোরিয়া ঘোষ, আজকের শ্রেষ্ঠ জয়ীতাদের অভিভাবকবৃন্দ, বিভিন্ন সেক্টর ক্যাটাগরির উদ্যোক্তারাসহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দসহ অন্যান্যরা।
উল্লেখ্য, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের জীবনযুদ্ধে সাফল্য অর্জনকারী ৭ জন শ্রেষ্ঠ জয়ীতাকে ৫টি ক্যাটাগরিতে সম্মাননা পুরষ্কার হিসেবে আর্থিক চেক, ১টি ক্রেস্ট ও সনদপত্র তুলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ জয়ীতাদের তালিকায় রয়েছেন – অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে- চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বেলেপুকুরের নূর ফাতেমা, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে-নাচোলের লাভলী ইয়াসমিন, সফল জননী নারী হিসেবে ভোলাহাটের কুলসুম আরা, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী শিবগঞ্জের তাসলিমা খাতুন, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নের মুণিকা সরেণ। এছাড়াও, উপজেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ জয়ীতাদের তালিকায় রয়েছেন- অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে- সদর উপজেলার বেলেপুকুরের নূর ফাতেমা, সফল জননী নারী হিসেবে মহিপুরের মোসা: রেহেনা বেগম, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী লক্ষীনারায়নপুর-ইসলামপুরের রাবেয়া, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নের মুণিকা সরেণ।
এদিকে, গোমস্তাপুরে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভা ও উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতাদের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সোমবার সকালে উপজেলা সভাকক্ষে স্থানীয় প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা কার্যালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার( ইউএনও) নিশাত আনজুম অনন্যা। সভায় অন্য অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মুসাহাক আলী, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিবার কর্মকর্তা আব্দুল হামিদ, সমাজসেবা কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা পঙ্কজ কুমার দাস, রহনপুর পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল হক, বিএমডিএ কর্মকর্তা আহসান হাবীবসহ অন্যরা। আলোচনা শেষে উপজেলার ৫ জন জয়িতাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।