জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বাংলাদেশ

783

<মাহমুদুল বাসার>

৮ সেপ্টেম্বর, উপমহাদেশের বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্মদিন। উনিশ শতকের শেষ দিকে, ১৮৯২ সালের এই দিনে তিনি পশ্চিম বঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদিনে ভাবছি, বামপন্থীরা তাঁর ওপর এত রুষ্ট কেন? পাকিস্তানি রাজনীতির গোলোক ধাঁধাঁর মধ্যে আমাদের কোনো নেতাই ভুলের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন নি। শেরেবাংলা ও মওলানা ভাসানীর স্ববিরোধী ভূমিকা এবং ভুল শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। আর বামপন্থীরা অন্যের ভুলের চর্চা এত নিখুঁতভাবে করে থাকেন যে, নিজেদের ভুলের ক্ষুদ্র পাহাড়টি লক্ষ্য করেন না। পাকিস্তানি শাসকরা তাঁকে বলেছিলেন, ‘ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর।’ এমন সম্ভাষণ মধুর সম্ভাষণ নয় নিশ্চয়ই। তিনি যে যুক্তবাংলা স্বাধীন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা বাঙালির ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। বাংলাকে যুক্ত রেখে স্বাধীন করার পক্ষে তিনি যে যুক্তিগুলো দিয়েছিলেন তা অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিস্তারে বীজের ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর মতো একজন প্রতিভাবান, উদার, মার্জিত, রুচিবান এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন নেতাকে এভাবে ভুল বোঝার কারণ কী? তিনিই সবচেয়ে বেশি জিন্নাহ, খাজা নাজিমুদ্দিন, মওলানা আকরম খাঁদের দ্বারা ষড়যন্ত্র ও অবিচারের শিকার হয়েছেন। পরপর দুইবার তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে। ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই তিনি ১৯৪৬ সালে যুক্তবাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আবার ষড়যন্ত্র করেই খাজা নাজিমুদ্দিনরা তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব কেড়ে নিয়েছেন। পূর্ববাংলায় সহজে তাঁকে পা রাখতে দেয়া হয়নি। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়ার পেছনে জিন্নাহর ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’ ঘোষণা কাজ করেছিলো, ঘোষণাটি ছিলো উস্কানিমূলক, এরপর খাজা নাজিমুদ্দিন বললেন, ‘আমাদের যুদ্ধ ইংরেজদের বিরুদ্ধে নয় হিন্দুদের বিরুদ্ধে।’ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না বাধালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি হালে পানি পায় না। এর জন্য সোহরাওয়ার্দীকে দায়ী করা অযৌক্তিক। জিন্নাহ এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা সোহরাওয়ার্দীকে বিপাকে ফেলেছিলো। জিন্নাহ এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা ও চক্রান্তের মাসুল সোহরাওয়ার্দীকে দিতে হয়েছে। আর যা-ই হোক সোহরাওয়ার্দী খাজা নাজিমুদ্দিনদের মতো চক্রান্তবাজ নেতা ছিলেন নাÑভুল তাঁর যতই থাক। তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব কেড়ে নেবার পরও তিনি মানসিক স্থৈর্য হারান নি, তিনি ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরও ভারতে থেকে গেলেন অসহায় সংখ্যালঘু মুসলমানদের পাশে দাঁড়াবার জন্য। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বলেছেন, ‘নাজিমুদ্দিন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়েই ঘোষণা করলেন, ঢাকা হবে রাজধানী এবং দলবলসহ ঢাকায় চলে গেলেন। একবার চিন্তাও করলেন না, পশ্চিম বাংলার হতভাগা মুসলমানদের কথা। এমন কি আমরা যে সমস্ত জিনিসপত্র কলকাতা থেকে ভাগ করে আনবো তার দিকেও ভ্রুক্ষেপ করলেন না।’ (পৃঃ ৭৮)।
মানবতার প্রতি এতটুকু দায়বদ্ধতা না থাকলে তিনি এতবড় নেতা হতে পারতেন না। সমগ্র ভারতে হিন্দু –মুসলমান যে দাঙ্গা লেগেছিলো তা থামানোর প্রাণপণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মহাত্মাগান্ধী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। উগ্র হিন্দুরা মহাত্মার সঙ্গে তাঁকেও হত্যার উদ্্েযাগ নিয়েছিলো। ভাগ্যগৃুণে তিনি বেঁচে যান। শান্তি স্থাপনে ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে ফরিদপুর হয়ে বরিশালে এসে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘যা হবার তা হয়ে গেছে। ভারত বিভাগ মেনে নিয়ে যে যেখানেই আছে, তাকে সেই দেশকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে হবে। দু’দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের তাদের দেশের সরকার ও সমাজকে মেনে নিতে হবে। যার যা ধর্ম তা সে পালন করবে। ধর্ম সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। ধর্মের কারণে রেষারেষি ও মানব নিধন ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের জন্যই ক্ষতিকর।’ (মাহমুদ নূরুল হুদাÑহোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,কাছ থেকে দেখা,পৃৃঃ১০৮)।
উগ্র হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর বঙ্গভাগের পক্ষে প্রচারণার বিপক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, ‘বাংলা যদি অবিভক্ত থাকে তাহা হইলে ইহা ভবিষ্যতে কতখানি উন্নত হইতে পারিবে, সে কথা আমাদের একবার াভাবিয়া দেখা উচিত। ইহা এক বিশাল দেশে পরিণত হইবে এবং ভারতের মধ্যে ইহাই হইবে সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধিশালী দেশ। প্রাচুর্যভরা ভবিষ্যতের বঙ্গদেশের অধিবাসীরা উন্নতধরনের জীবন যাপন করিতে সক্ষম হইবে এবং উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করিতে পারিবে। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য সম্পর্কে ইহা সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠিবে এবং কালে জগতের অন্যতম শক্তিশালী ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত হইবে।’ (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কাছ থেকে দেখা, পৃঃ ৫৩)।
সোহরাওয়ার্দীর এই স্বপ্ন মিথ্যা ছিলো না। বাংলাকে অবিভক্ত রাখার পক্ষে তিন জন বিখ্যাত বাঙালির চেষ্টা ইতিহাস হয়ে আছে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাশিম।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট গঠনে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা ছিলো অনন্য সাধারণ। এটা প্রমাণিত সত্য যে, শেরে বাংলা এবং মওলানা ভাসানীর চেয়ে সোহরাওয়ার্দীর সাংগঠনিক প্রতিভা অনেক বেশি ছিলো। তিনি নিয়মের পূজারি ছিলেন। পাকিস্তানে বিরোধী দল গঠন করার কৃতিত্ব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। ১৯৫৪ সালের মধ্যে তিনি আওয়ামীলীগকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছেন। যুক্তফ্রন্টের শরীক দলের মধ্যে আওয়ামীলীগই বড় দল ছিলো। যুক্তফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্রে এবং নির্বাচনে বিজয় লাভের ক্ষেত্রে সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা ছিলো মুখ্য। দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর অবদান ছিলো। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে দৈনিক ইত্তেফাকের ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল।
বলতে গেলে ঘটনাচক্রে মাত্র ২১ জন সংসদ নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্র্র্র্র্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এর ফলে তিনি পার্লামেন্টে যুক্তনির্বাচন প্রথার বিল পাস করাতে সক্ষম হন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় ভারত তো শত্রু ছিলোই চীন-রাশিয়াও পাকিস্তানের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন ছিলো। প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেন। তাঁর মন্ত্রী সভার সদস্য আবুল মনসুর আহমদ ভারত সফর করেন, সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
‘ক্ষমতা গ্রহণের র্পপরই বিশ্বের অন্যতম মহাশক্তি চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৬ সালের ২২ অক্টোবর সরকারি সফরে চীন গমন করেন। ফলে পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন- লাই ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সফরে আসেন। সোহরাওয়ার্দী চীনের নেতাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, চীন ও পাকিস্তান আলাদা রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও তারা পরস্পর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সাথে বাস করতে পারে। পাকিস্তান চীনে একটি উচ্চ পর্যায়ের বাণিজ্যপ্রতিনিধি দল পাঠায়। চীনও তাদের বাণিজ্য প্রতিনিধি দল পাঠায়। ফলে দুদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।’ (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কাছ থেকে দেখা, পৃঃ ৭৯)।
‘১৯৫৭ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পরিষদ অধিবেশনে সোহরাওয়ার্দী যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে যে বক্তৃতা করেন, এর পক্ষে পরিষদের সমর্থন আদায় করেন তা ছিলো ঐতিহাসিক। (আবুল কাসেম ফজলুল হকাÑমুক্তিসংগ্রামক)।
পাকিস্তানে স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যে নয় নেতা যুক্ত বিবৃতি দিয়ে আইয়ুবের পতনের বীজ রোপন করেছিলেন তাকে সমর্থন করেছিলেন সোহরাওয়ার্দী। তিনি এনডিএফ গঠন করেছিলেন পূর্ববাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে, আইয়ুবের পতন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। তাঁকে কারারুদ্ধ করার পর পূর্ব বাংলায় গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিলো। আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনাকালে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে তিনি ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতে মৃতুবরণ করেন।

লেখক-কলাম লেখক ও গবেষক