চ্যালেঞ্জের বছর ডলার সংকট-মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য

53

বছরজুড়েই অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রে ছিল রিজার্ভ-সংকট। এর সঙ্গে উদ্বেগ তৈরি করে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ। চলমান এই সংকটে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় হুহু করে। এক যুগের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে যায়। নানান ঘটনা আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তে জড়িয়ে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে। বলা যায়, সারা বছরই আলোচনায় ছিল আইএমএফের ঋণ। অবশ্য এরই মধ্যে ঋণের দুই কিস্তি দিয়েছে আইএমএফ। পাশাপাশি কিছুটা হলেও বাড়ছে রিজার্ভ। বছর শেষে এটুকু স্বস্তি নিয়ে পার হলো ২০২৩ সাল। ডলার-সংকটের শুরুটা অবশ্য আগের বছর থেকে। রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরু করলে ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি তেল ও পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। ডলারের দাম তখন ছিল ৮৪ থেকে ৮৬ টাকা, যা বেড়ে এখন কাগজে কলমে ১১০ টাকায় উঠেছে। অবশ্য খোলা বাজারে ১২৪ টাকা ছাড়িয়েছে ডলারের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন ডলারের দাম ধরে রেখেছিল। এর ফলে কমতে শুরু করে রিজার্ভ। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মোট রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এখন ২০ বিলিয়নের ঘরে নেমে এসেছে। গত দেড় বছরে দেশে ডলারের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি উঠেছে। ডলারের কারণে অনেকে ব্যবসা ছোট করে ফেলেছেন। আবার ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে গেছে। এ জন্য ডলার-সংকটের বিষয়টি বছরজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। তবে স্বস্তির দিক হলো আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া গেছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সুদহার বৃদ্ধিসহ নানা উদ্যোগ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সংকট কেটে যায়নি। কারণ রিজার্ভ বাড়ছে খুব ধীরগতিতে। তাই আসছে নতুন বছরে রিজার্ভ আর ডলার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত নভেম্বরে এই হার ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশে নেমে আসলেও স্বস্তি আসছে না। গত বছর জুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছিল আলোচনায়। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষ করে গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বেড়েছে। এখন বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। কখনো ডিমের দাম বাড়ে আবার কখনো পেঁয়াজ, আলুর দাম বাড়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত এক বছরে যে সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার সুফল খুব কমই মিলেছে। বিশেষ করে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অমূল্যায়নের কারণেই এখনো মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে বড় চাপের সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য সরবরাহে বাধা, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্য, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের জ্বালানি, বিদ্যুত্ ও গ্যাসের দামের ঊর্ধ্বমুখী সমন্বয় ও বাজারের অপূর্ণতা মূল্যস্ফীতির হার বাড়াচ্ছে। শীতে সাধারণত মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে। কারণ এ সময়ে সবজিসহ সব পণ্যের উত্পাদন বেশি হয়। এ কারণে সরবরাহ বাড়ে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে যায়। এছাড়া গত দুই অর্থবছর ধরে মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম টানতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে টাকার প্রবাহ কমানো হচ্ছে। এর ফলে দেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে ডলার-সংকটের কারণে ব্যবসার খরচও আগের চেয়ে বেড়েছে। সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ছে। আগে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে সীমিত ছিল। এখন তা বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পণ্যের উত্পাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতেও মূল্যস্ফীতির হারে চাপ আসবে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স শুধু বৈদেশিক মুদ্রার গুরুত্বপূর্ণ উত্সই নয়, এগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য চালকও। অন্যতম প্রধান এই আয়গুলোর প্রবাহ কমে গেলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে যেতে পারে। তবে আশার দিক হলো এ বছর ২৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসতে পারে। বিশ্বব্যাংকের এক পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী বছরও ২৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যন্স পেতে পারে বাংলাদেশ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল। তখন প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার। ইপিবির তথ্য অনুসারে, নভেম্বর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পণ্য রপ্তানি ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ পিছিয়ে আছে। সামনের দিনগুলোতে রপ্তানির গতি বাড়লে অর্থনীতির চাপ কিছুটা হলেও কমে আসবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।