চরের বুকে ভেড়ার পাল, খুলে দিল শুকচানের কপাল

235

আমরা শিক্ষাজীবনে পড়েছি, “পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি”। মোদ্দা কথা সাফল্য কখনো একা একা পায়ে হেঁটে আসে না। এই সাফল্যতা অর্জনের জন্য একটি রাস্তার প্রয়োজন।  আর এই রাস্তাটায় হল পরিশ্রম। মানব জীবনে উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করতে চাইলে দৃঢ় সংকল্প ও পরিশ্রম একান্তই প্রয়োজন।

তাই আজ আপনাদের একজন দৃঢ় সংকল্পকারী ও পরিশ্রমী ব্যক্তির কথা শোনাবো। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার চরপাকা নিশি পাড়া গ্রামে বসবাস মোহাম্মদ সুখ চান মিয়ার। স্ত্রী শিরিনা বেগম তার দুই ছেলে এবং মেয়ে।

কথায় আছে নদীর একুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা এমনই এক নদী ভাঙ্গন এলাকায় বসবাস মোহাম্মদ সুখচান মিঞার। পদ্মা নদীর করালগ্রাসে শত শত হেক্টর আবাদি জমি বিলীন হয়ে গিয়েছে, কোথাও জেগেছে চর। কিছু কিছু জায়গায় বোরো মৌসুমের ধান ছাড়া অধিকাংশ জায়গায় কোন ফসল ফলানো সম্ভব হয় না। বছরের বেশির ভাগ সময় পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে। এলাকায় স্থানীয়দের অনেকেরই বিঘা বিঘা জমি থাকার পরেও মেটে না তাদের সংসারের অভাব। বিধায় পাড়ি দিতে হয় শহরাঞ্চলে কাজের উদ্দেশ্যে। আধুনিক বিশ্বের ডিজিটাল বাংলাদেশে,যেখানে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে দেশ। ঠিক সেখানে যেন নিত্য নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সভ্যতার অন্তরালে,  অবহেলায় পিছিয়ে পড়ে রয়েছে অঞ্চলটি।

অঞ্চলটিতে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন ও সমাজসেবামূলক কাজ করে আসছে প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি। উক্ত  চরাঞ্চলের কথা বিবেচনায় এনে প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি ২০১৮ সালের শেষের দিকে,  পিকেএসএফ এর অধীনে পরিচালিত লিফট ল্যান্ড লিজ কর্মসূচি এর আওতায় কৃষি- প্রাণিসম্পদ সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ  উন্নয়ন ভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা ও কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করে আসছে।

অঞ্চলটির ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় এনে সেখানে ভেড়া পালন প্রদর্শনী বাস্তবায়নের জন্য সদস্য নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কতিপয় কিছু মৌলিক বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করে উক্ত স্থানে ভেড়া পালন প্রদর্শনী বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কথায় আছে উটকে মরুভূমির জাহাজ বলা হয়। তাহলে মরুভূমি নৌকা কে হবে? মোদ্দা কথা হল ভেড়ার এমন কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা হয়তো অনেকেরই অজানা-

১.ভেড়া একটি উৎপাদনশীল রোমান্থনকারী প্রাণী।

২.এর খাদ্য খরচ খুবই কম।

৩.ভেড়া খুবই নিম্নমানের খাদ্য  খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।

৪.ভেড়ার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাগলের চাইতে অনেক বেশি।

৫.এরা  ঝড় বৃষ্টি রোদ  ইত্যাদি সহ্য করার ক্ষমতা রাখে।

৬.একসাথে অনেক ভেড়া দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে।

প্রয়াসের প্রতিনিধি যখন সদস্য তালিকাভুক্ত করছিলেন। তখন প্রয়াসের একজন সদস্য মোসাম্মৎ শিরিন এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার আলাপ হলে, শিরিন পূর্বে তার ভেড়া পালনের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। মোসাম্মৎ শিরিন বলেন “আমি প্রায় চার বছর আগে থেকেই ভেড়া পালন করে আসছি। আমাদের এই অঞ্চলে ভেড়া অনেকেই পালন করে, কিন্তু বেশি পরিমাণে না। সকলেই মোটামুটি চার থেকে পাঁচটি করে ভেড়া পালন করে। আমারও বর্তমানে সাতটি ভেড়া আছে। কিন্তু ভেড়া গুলি মাঝে মাঝে বিভিন্ন রোগে মারা যায়। মা ভেড়াগুলো বাচ্চা প্রসব করলেও অধিকাংশ বাচ্চা মারা যায়”।

মোছাম্মদ শিরিনের সাথে আলাপচারিতার পর, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ভেড়া পালনের আধুনিক প্রযুক্তিগুলো সম্পর্কে ধারণা দিলে, শিরিন প্রবল আগ্রহের সাথে তার স্বামী শুকচান এর সহিত কর্মকর্তার কথা বলিয়ে দেন। পরবর্তীতে ভেড়া পালনের জন্য শুকচান কে সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে, তাকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভেড়া পালনের উদ্বুদ্ধ করেন। এবং বিভিন্ন পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।

সুখ চান মিয়া প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সহযোগিতা গ্রহণ করে, প্রয়াস হতে এক বছর পূর্বে ৫০০০০ টাকা লোন নিয়ে নিজের বাড়ির পাশে একটি খামার তৈরি করেন এবং বাড়ির সাতটি  ভেড়া সহ আরো ২০ টি মা ভেড়া ৪৫০০ টাকা দরে ক্রয় করেন, এবং দুইটি ভালো মানের  পুরুষ ভেড়া (গাড়ল) ১২০০০ টাকা দরে ক্রয় করেন। ছয় মাস পরে তার ২৫ টি মা বেড়া হতে ৩৮ টি ভেড়ার বাচ্চা লাভ করেন। সকল ভেড়াকে তিনি প্রকল্পের হতে প্রাপ্ত ভ্যাকসিন প্রদান ও কৃমিনাশক নিয়মিত সেবন করান। এইভাবে তিনি ২০১৯ সালের জুলাই মাসে তার খামার থেকে  সাতটি ভেড়া বিক্রয় করে, পুনরায় ২০ টি ভেড়া ক্রয় করেন।  তিনি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তার খামারের ৩৮ টি ভেড়া হতে ৪২ টি বাচ্চা লাভ করেন। বর্তমানে তার খামারের বয়স এখন প্রায়  দুই বছর। সুখচানের নিয়মিত দুইজন শ্রমিক কাজ করে। খামারে এখন তার ভেড়ার সংখ্যা, বাচ্চা সহ মোট ১৫০ টা এরমধ্যে বিক্রয়যোগ্য ভেড়া রয়েছে প্রায় ৭০ টি। যা প্রায় ৪,২০,০০০ টাকার সম্পদ।

সুখ চান মিয়া প্রথমে এক লক্ষ ১৪ হাজার টাকা দিয়ে ভেড়ার খামার শুরু করেন এবং প্রথম দফায় তিনি ৩৮৫০০টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ১,২০,০০০ টাকা মোট  ১,৫৮,০০০ টাকা উপার্জন করেন।

বর্তমানে তার দেশি ভেড়া গুলি ধীরে ধীরে উন্নত জাতের ভেড়া (গাড়ল) দ্বারা প্রজনন করায়, জাতের উন্নয়ন ঘটছে এবং উৎপাদন ক্রমানুসারে বেড়েই চলেছে।

শুকচান বলেন আমি পরিশ্রম করতে ভয় পাইনা। এর পূর্বে ও আমি বিভিন্নভাবে সফল হওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হওয়াই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু মহান আল্লাহ প্রয়াসের মাধ্যমে ভেড়ার খামার স্থাপনে আর্থিক ও বিভিন্নভাবে কারিগরি সহযোগিতার দরুণ আজ আমি এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি। তার কাছে বর্তমান অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি একটাই কথা বলেন “জীবনে সৌভাগ্য বলে কিছু নেই, যদি না সঠিক পরিশ্রম করি”।