গাছে গাছে দুলছে আমচাষিদের স্বপ্ন ৪ লাখ মে.টন উৎপাদনের প্রত্যাশা
আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সুস্বাদু সুমিষ্ট আমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এই জেলায় উৎপাদিত আমের সুনামের কারণে অন্য জেলার আমকেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এবার আমের রাজধানীতে ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর বাগানে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় চার লাখ মেট্রিক টন।
কিছুটা বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও এবার প্রায় শতভাগ আমগাছে মুকুল এসেছিল। মৌসুমের শেষের দিকে অতিমাত্রায় ঠাণ্ডার মধ্যেও গাছে গাছে মুকুল দেখে কৃষকদের মনে হয়েছিল, এবার আমের ফলন ভালো হবে। তবে শেষ পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭০ ভাগ গাছে আম দেখা দেয়। যা দেখে আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা স্বপ্ন বুনছেন লাভের আশায়। মাঝখানে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার আম বেচাকেনা হতে পারে অনেকেই মত প্রকাশ করেন।
ক্যালেন্ডারের হিসাবে আসছে মে মাসের শেষের দিকে অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠের মধুমাসে বাজারে নামবে বাহারি সব আম। জেলার বাগানগুলোয় এখন শোভা পাচ্ছে ছোট থেকে বড় বড় আমের গুটি। এদিকে চৈত্রের শুরুতে দুই দফায় বৃষ্টি হওয়ায় আমের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনলেও এক সপ্তাহ আগে থেকে চলমান খরা ও মৃদু তাপপ্রবাহ আম উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আমচাষিরা।
বাগানের সবচেয়ে ছোট গাছের গুটি মটরদানা ও মার্বেলের আকারে শোভা পাচ্ছে। তবে বাগানের অধিকাংশ বড় গাছে আমের মুকুল ও গুটি হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম। খরার কারণে বাগানে গুটি আম শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে। খরায় আমের গুটি যাতে ঝরে না পড়ে তাই এরই মধ্যে বাগানে সেচসহ বিভিন্ন পরিচর্যা করছেন আমচাষিরা। এছাড়া ক্ষতিকর পোকা দমনে বাগানে কীটনাশক স্প্রেও করছেন তারা।
বাগানমালিক ও আমচাষিরা জানিয়েছেন, এক বছর ভালো ফলন হলে পরের বছর কম ফলন হয়। ফলনগত দিক থেকে স্থানীয়দের কাছে কমের বছর ‘অফ ইয়ার’ এবং ভালো ফলনের বছর ‘অন ইয়ার’ হিসেবে পরিচিত। সে হিসাবে এবার অন ইয়ার, বলছেন তারা। আমচাষিরা বলছেন, আবহাওয়ার কারণে এবার আম গাছগুলোয় বেশি বেশি পরিচর্যা করতে হচ্ছে। গতবছরের তুলনায় এবার বালাইনাশক, রাসায়নিক সার বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। এদিকে চৈত্রের তেজেও বোটা শুকিয়ে গুটি ঝরে যাচ্ছে। তাই বাড়তি খরচে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে এবার আম উৎপাদনে খরচ বেড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাজুড়ে আম চাষাবাদ হয়েছে ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও জেলার অন্যতম আমচাষি মুনজের আলম মানিক বলেন- এবার অন ইয়ার হিসেবে যতটা আম হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। তার কারণ, মুকুলের সময় হালকা বৃষ্টি, রাতের তাপমাত্র কমে যাওয়া এবং দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। সবমিলিয়ে আমচাষে এবার প্রতিকূল আবহাওয়া বিরাজ করছে। তবে বাগানে পর্যাপ্ত আম আছে। তিনি বলনÑ গতবছরের তুলনায় এবার সার-কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের খরচও বেড়েছে। গতবছর শ্রমিকের মজুরি ছিল সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, এবার ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। ইউরিয়া সারের দাম শতকরা ২৫ ভাগ বেড়েছে। এছাড়া কীটনাশকের দাম ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
মানিক আরো বলেন- বরেন্দ্র এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারের কারণে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। সবমিলিয়ে চাষিদের এবার আম উৎপাদনে খরচ অনেকটা বৃদ্ধি পাবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. ইয়াছিন আলী কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি বিষয়ে বলেন- কোনো কোম্পানি যদি দাম বৃদ্ধি করে থাকে, তাহলে সেটার বিষয়ে তো কারোর কিছু করার নেই। তবে প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্ধারিত মূল্যের অধিক কেউ নিলে সেটা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে আমরা দেখব। তবে সারের দাম বৃদ্ধির কোনো সুযোগই নেই বলে জানান।
আমের উৎপাদন বিষয়ে তিনি বলেন- মাঝখানে কিছুটা খরা গেল, সেই কারণে এবং যারা সেচ দেয়নি তাদের বাগানে কিছুটা গুটি ঝরেছে। তবে যারা সেচ দিয়েছে, তাদের বাগানে আমের কোনো ক্ষতি হয়নি। আমের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য কৃষি বিভাগ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে এবার জেলায় ৩ লাখ ৮৬ হাজার ২৯০ মেট্রিক টন আমের ফলন হতে পারে বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শীর্ষ এই কর্মকর্তা।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ বলেনÑ শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার আশা করা যায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে। এর বাজার মূল্য হবে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় যেসব আমচাষ হয় তার মধ্যে প্রথমে বাজারে আসে বিভিন্ন ধরনের গুটি আম। এরপর সুমিষ্ট আমগুলোর মধ্যে আসে গোপাল ভোগ। এটি শেষ হবার আগেই আসে সুস্বাদু ক্ষিরসাপাত। এরপর আসে লক্ষণভোগ, আ¤্রপালি, বারি-৪, আমের রাজা ফজলি। সব শেষে আসে টকমিষ্টি স্বাদের আশি^না। এর মধ্যেই আসে হালে চাষ হওয়া কাটিমনসহ অন্যান্য আম।