Site icon রেডিও মহানন্দা ৯৮.৮ এফএম

কৃষি ও সবুজায়নে নারীর ভূমিকা

রাফেয়া আবেদীন

নারী ও প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কোনোভবেই কোনো ধরনের বৈপ্লবিক অবস্থাকে বোঝায় না, বরং তাদের এই সম্পর্কের ভেতরে নারী ও প্রকৃতি উভয়েই প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের গ্রামীণ নারীর অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা যায় যে প্রকৃতি ও নারীর সম্পর্ক কেবল প্রভাব বিস্তারকারী নয় বরং জীবন রক্ষাকারীও বটে। কাজেই জীবনের প্রয়োজনে, আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে সবুজায়নে নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ে অত্যন্ত দ্রুত ইতিবাচকভাবে ভাবা প্রয়োজন। নারী প্রকৃতিরই অবিচ্ছিন্ন অংশ। ভারতের পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী বন্দনা শিবার মতে, ‘একটা পর্যায় পর্যন্ত প্রকৃতি হলো নারীসুলভ রীতির প্রতীকীকৃত রূপ। আরেকটি পর্যায় হলোথ প্রকৃতি নারীর দ্বারা লালিত হয় জীবন ও খাদ্য প্রদানের নিমিত্তে।’ কেননা আমরা জানি, আদিমযুগ থেকে মানুষ যখন যাযাবর, অরণ্যচারী ও গুহাবাসী ছিল, পশু শিকারই ছিল খাদ্যের প্রধান উৎস। ক্রমইে মানুষ স্থায়ী বসবাস করতে শুরু করে। শুরু করে পশু পালন ও কৃষিকাজ। মানুষের স্থায়ী বসবাসের ফলে পশু পালন ও কৃষিকাজের সূচনা করে নারী। কারণ, সন্তান ধারণ করার ফলে নারীকে তখন গৃহবাসী হতে হয়। এই সময়ই নারী মাংশের প্রয়োজনে অতিরিক্ত পশু সংরক্ষণের সুযোগে পশু পালন শুরু করে। অন্যদিকে বনের ফলমূল সংরক্ষণ ও ছড়িয়ে পড়া বীজ থেকে চারা জন্মাতে দেখে নারীর হাতে কৃষিকাজেরও সূচনা হয়। এভাবে নারী হয়ে ওঠে প্রকৃতির অবিচ্ছিন্ন একটি সত্তা। নারীর হাতে কৃষিকাজের সূচনা হয়েছিল, এবং এখনও পর্যন্ত, বিশেষ করে বাংলাদেশে, কৃষিতে ব্যাপক সংখ্যক নারী কাজ করে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত এক দশকে এক কোটি বিশ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, কৃষি-বন-মৎস্য খাতেই যুক্ত হয়েছে ত্রিশ লাখ কর্মসংস্থান। গত এক দশকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের নিমিত্তে প্রায় এক কোটি ত্রিশ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তি যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ লাখই নারী শ্রমিক। ২০০৫-০৬-এর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের এক কোটি বিশ লাখ নারী শ্রমিকের প্রায় ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী, যারা মূলত কৃষি, পশুপালন, হাঁসমুরগি পালন, মাছ চাষ ইত্যাদি কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত। ১৯৯৯-২০০০ সময়কাল থেকে ২০০৫-০৬ সময়কালে কৃষি-বন-মৎস্যখাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৭৭ লাখ হয়েছে [১০৮ শতাংশ বেড়েছে]। অন্যদিকে এই সময়কালে এই খাতে পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে ২.৩ শতাংশ। ২০০২-২০০৩ সময়কালের তুলনায় কৃষি-বন-মৎস্যখাতে পুরুষ শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমেছে প্রায় ১০.৪ শতাংশ। কৃষিতে ফসল তোলার-পরবর্তী কর্মকান্ড, বীজ সংরক্ষণ, নার্সারি ব্যবসা, পাটের আঁশ ছাড়ানো, সবজি উৎপাদন, গৃহাঙ্গন কৃষি, ফুলের চাষ, ফল-ফুল ও সবজি বীজ উৎপাদন, স্থানীয় কৃষিজ পণ্যভিত্তিক কুটিরশিল্প স্থাপন ও পরিচালনা প্রভৃতি কাজে নারীরা অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া বীজ রোপণ, মাচা বাঁধা, সেচ দেয়া, ফসল তোলা, ফসল শুকানো, বাড়িতে তা সংরক্ষণ ইত্যাদি থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণও অনেক ক্ষেত্রে নারীকেই দেখভাল করতে হয়। এভাবে নারী যেমন প্রকৃতিকে সজীব রেখেছে, অন্যদিকে সবুজায়নে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে ক্রমাগত গ্রিনহাউসের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য রাখতে সহায়তা করছে।
তবে খাদ্য উৎপাদন, ফসল ফলানোর বাইরে কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন, পশু পালন, মৎস্য চাষ, হাঁসমুরগি পালন ইত্যাদি কাজ যেমন অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীদেরই করতে দেখা যায়। এক অর্থে এ জাতীয় কাজগুলোও কৃষিকাজের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে আপাত দৃষ্টিতে অ-আর্থিক পর্যায়েও বৃক্ষ রোপণ করে নারী পরিবেশকে সবুজ করে রাখে। যেমন উঠোনের কোণে, বাড়ির পাশে এক চিলতে স্থানে নারীরা ফুলের গাছ, পাতাবাহারের গাছ লাগায়। পরিচর্যা করে। এর ফলে পরিবেশের সৌন্দর্যবর্ধন ঘটে, আবার প্রকৃতি হয়ে ওঠে সবুজ।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশের মাটি প্রায় সর্বত্রই উর্বর। এখানে ঘাসের ওপর বীজ ছড়িয়ে দিলে ফসল জন্মে। কিন্তু একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, যত উর্বরই হোক না কেন সঠিক পরিচর্যা, সময়োপযোগী সংরক্ষণ ব্যবস্থা, পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট কাজে মানুষের উৎসাহ না থাকলে কোনো কিছুই যেমন খুব উন্নত করা যায় না, তেমনি প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও এ ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন। বাংলাদেশ গ্রাম ও নদীবিস্তৃত হলেও আমাদের শহরগুলোতেও প্রকৃতিকে সঠিকভাবে ব্যবহার, পরিচর্যা ও কাজে লাগানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে।
নদীর দুই তীর, গ্রাম-গঞ্জের রাস্তার পাশে বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গাছ লাগানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে গাছ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সর্বত্রই প্রায় বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে। এসব গাছের অনেকই এদেশের মাটি ও আবহাওয়ার উপযুক্ত নয় বা বলা যায়, এসব গাছ আমাদের দেশের পরিবেশের জন্য সহায়ক নয়, বরং অনেকক্ষেত্রে ক্ষতিকর। কাজেই গাছ নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি দেয়া যেমন প্রয়োজন তেমনি কৃষি ও প্রকৃতির সঙ্গে নারীর ঐতিহাসিক যোগসূত্রের কারণে তাদের এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
কৃষিকাজের মতো ভারী কাজে নারীরা সহজেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। আর শহরের রাস্তার আইল্যান্ড, পার্ক বা পরিত্যক্ত স্থানগুলোতে নারীরা সবুজায়ন ঘটাতে পারে। এসব কাজে নারীদের অংশগ্রহণে একদিকে নারীদের কর্মসংস্থান ঘটবে, অন্যদিকে নারী তাদের সুনিপুণ হস্তশিল্পের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সবুজায়নের ক্ষেত্রে আনতে পারে নান্দনিকতার ছোঁয়া।
নারীর সৌন্দর্যপ্রিয় এবং তাদের ভেতর বলিষ্ঠতা আছে। ফলে নগর উন্নয়নে ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে তারা বিশেষ অবদান রাখতে পারবে। নারী যেমন পোশাকশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে তেমনি কৃষিক্ষেত্রে ও সবুজায়নে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। বীজ তোলা এবং শস্য রক্ষণাবেক্ষণ বললেই অবহমান বাঙালি নারীর অবয়ব ভেসে ওঠে। একইভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, পরিবেশ সৌন্দর্যবর্ধনে নারীর শক্তি, মেধা, সৌন্দর্যবোধ কাজে লাগানো যেতে পারে।
কৃষি এবং সবুজায়নের মধ্য দিয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা যেমন আসে, তেমনি রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নারী ভূমিকা রাখছে। যদিও জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর এই শ্রম যুক্ত করা হচ্ছে না। ‘নারী’কে বরাবরই উপস্থাপন করা হয় ‘বিপদাপন্ন’ জনের অংশ হিসেবে, অর্থনৈতিক কাজে নিয়োজিত সক্রিয় এজেন্ট হিসেবে নারী কখনোই বিবেচিত হয়নি। ১৯৫০-এর দশক থেকে জাতীয় আয় পরিমাপনে টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঝুংঃবস ড়ভ ঘধঃরড়হধষ অপপড়ঁহঃরহম [টঘঝঘঅ] পদ্ধতি অনুসরণ করা শুরু হয়। টঘঝঘঅ-এর আওতায় দূরবর্তী গনন পদ্ধতির [ঝধঃবষষরঃব ঈড়ঁহঃরহম] মাধ্যমে পৃথকভাবে বাজারের বাইরের শ্রমকে অর্থনৈতিক অবদানের আদলে দেখার চেষ্টা হচ্ছে, তবে তা টঘঝঘঅ-এর মূল হিসেবে এখনও ঢোকেনি। পৃথিবীর অপরাপর দেশের মতো বাংলাদেশের জাতীয় আয় পরিমাপনেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেখানেও পারিবারিক অবৈতনিক কর্মে নিয়োজিতদের অবদান এখনও অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হয়নি। অর্থাৎ অর্থনীতিতে নারীর অবদান এখনও পুরোপুরি স্বীকৃতি পায়নি। অন্যদিকে কম মজুরি সত্ত্বেও অন্য কাজের সুযোগ সীমিত হওয়ায় এবং ঘরের কাজের পাশাপাশি কৃষিকাজে অংশ নেয়া যায়থ এতসব বিবেচনায় গ্রামীণ নারী কৃষিতে শ্রম দিচ্ছেন। যার অধিকাংশই মজুরি-বহির্ভূত পারিবারিক শ্রম। এ ক্ষেত্রে সারাদেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে। তবে সংখ্যাধিক্যের কারণে নিয়োজিত কিষাণীকে ঠকিয়ে কম মজুরি দেওয়ার প্রবণতাও সমানভাবে চলছে। প্রচলিত জনপ্রিয় ধারণা হলো, গার্মেন্টস আমাদের নারী শ্রমিকের একমাত্র ভরসাস্থল। লক্ষণীয় হলো, ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-০৬ সময়কালে উৎপাদনমুখী শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে ৬.৭ শতাংশ। তাহলে তো সাধারণভাবে উৎপাদনমুখী শিল্পে এবং বিশেষভাবে রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস শিল্পের অগ্রযাত্রায় নারীর শ্রমের ক্রমবর্ধমান বিকাশ ঘটছে বলে যে কথাটা চালু আছে, তার তেমন সারবত্তা নেই। তুলনায় কৃষিখাতই নারীকে বেশি কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে, ঠকানো ও শোষণ সত্ত্বেও নারীকে স্বাবলম্বী হবার পথ খুলে দিচ্ছে। অথচ কী আশ্চর্য, কৃষিতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের ‘পরিচয়’ নামের ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকু নেই! সবুজায়নে ও কৃষিতে নারীর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি যেমন অত্যন্ত জরুরি তেমনি নারীর জন্য এ ধরনের কাজে অংশগ্রহণের আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করাও প্রয়োজন।

প্রকৃতি ও নারীকে জীবন উৎপাদনকারী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করলে, এর থেকে দু’ধরনের অর্থ দাঁড়ায়। প্রথমত, উন্নয়নের নামে যা কিছু হচ্ছে তা হলো অব-উন্নয়ন, যা পৃথিবীব্যাপী নারী ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার উৎস। এই সহিংসতা কোনোভাবেই একটা লিঙ্গ-নিরপেক্ষ উপকারী মডেলে অপপ্রয়োগের ফসল নয়, বরং এর মূল নিহিত রয়েছে সমরূপতা, অধস্তনতা ও কেন্দ্রিকতার পুরুষতান্ত্রিক ধারণার ওপর যা উন্নয়নের রণকৌশল তৈরিতে প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে। দ্বিতীয়ত, অব-উন্নয়ন প্রচেষ্টা থেকে উত্থিত বিভিন্ন সংকটের সমাধানকে কোনোভবেই এই উন্নয়ন রূপকল্পের সংকটপূর্ণ মানসিকতার মধ্যে সম্ভব নয়। এর সমাধান নিহিত রয়েছে জীবন সংগ্রামের প্রক্রিয়া ও জীবনরক্ষাকারী নানা ধরনের চিন্তা ও ধারণার মধ্যে। শুধু ক্ষতিগ্রস্ত নারী হিসেবেই নয়, বর্তমান পরিবেশগত সংকট নিরসনে নারীরা প্রধান ভূমিকায় নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ নারীরাই প্ররিবেশগত সংকট নিরসনেও মোকাবেলার জন্য কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখতে পারে। নারী ও প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কোনোভবেই কোনো ধরনের বৈপ্লবিক অবস্থাকে বোঝায় না, বরং তাদের এই সম্পর্কের ভেতরে নারী ও প্রকৃতি উভয়েই প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের গ্রামীণ নারীর অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা যায় যে প্রকৃতি ও নারীর সম্পর্ক কেবল প্রভাব বিস্তারকারী নয় বরং জীবন রক্ষাকারীও বটে। কাজেই জীবনের প্রয়োজনে, আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে সবুজায়নে নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ে অত্যন্ত দ্রুত ইতিবাচকভাবে ভাবা প্রয়োজন।

লেখক : রাফেয়া আবেদীন, কবি, প্রকৃতি ও নগর সৌন্দর্যবিদ

Exit mobile version