ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের ইঙ্গিতবাহক

129

মোস্তাক হোসেন

৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশ উদ্ভবের তাৎপর্যময় বার্তা বাহন। ভাষণে অবজ্ঞায় পতিত ও নির্যাতিত বাঙালি জাতিকে পরাধীনতা ও শোষণের কবল হতে মুক্তি পাবার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে। তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনতার সম্মুখে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত বাঙালির মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে এই ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন। এই ভাষণের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে হলে বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসের দিকে নজর দেয়া খুবই প্রয়োজন।
ইংরেজ শাসনামলের শেষাংশে ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের লাহোরে ভারতবর্ষ বিভক্তির প্রাক্কালে ‘লাহোর প্রস্তাব’ পেশ করা হয়। প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয় যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হিসেবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চল দুটি স্বাধীন ভূখ- থাকবে (ড. আবুল ফজল হক : বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতি, অনন্যা প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৬৯)। এই প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল; যা কিনা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মকেন্দ্রিক প্রাধান্যতার ওপর নির্ভরশীল। ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলকে ঘিরে পাকিস্তান এবং হিন্দুদের নিয়ে ভারত নামক দুটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে। জাতিরাষ্ট্র দুটির মূল উদ্দেশ্য নিজ নিজ জাতিধর্মের নিরাপত্তার পাশাপাশি সার্বিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। কিন্তু তা হয়নি। লাহোর প্রস্তাবে উল্লেখিত প্রস্তাবনাকে না মেনে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে বটে, অথচ বাঙালির ভাগ্যে মুক্তির বিকল্পে ইংরেজ শাসনামলের ন্যায় কলোনিয়ান শোষণ জুটে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আবাসভূমিকে পূর্ব পাকিস্তান নাম দিয়ে পাকিস্তানের প্রদেশ বানায়। এমনটি এই ভূখ-ের জনগোষ্ঠী কামনা করেনি। কেবলমাত্র তারা তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে একেবারে ইংরেজদের ন্যায় কলোনিতে পরিণত করে রাখতে এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করেছিল ।
কলোনি করার দুরভিসন্ধি প্রকাশ পায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ বাংলা সফরে। তিনি ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা অন্য ভাষা নয় এবং এ ব্যাপারে যারা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে তারা পাকিস্তানের শত্রু (স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, গ্রন্থকুটির প্রকাশন, মার্চ ২০২১, পৃষ্ঠা ১৮৬)। শোষণের বাসনায় বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা প্রচলনের মূল অভিলাষ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিদের চিন্তাভাবনা বাঙালির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে পারলেই বাংলার জনগণকে শোষণ করা যাবে। কিন্তু তা এদেশের মানুষ বুঝতে পারে এবং বাংলা ভাষার দাবি ধীরে ধীরে পঞ্জীভূত হয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের চূড়ান্ত রূপ নেয় (University of Dhaka: Making Unmaking Remaking,  Edited by Imtiaz Ahmed and Iftekhar Iqbal, Published by Prothoma Prokashan, page 60)। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী পর্যায়ে একের পর এক শোষণ ও বৈষম্য হতে বাঙালিকে রক্ষা করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনে তাগিদ অনুভব করে ছয় দফার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য ও শাসনতান্ত্রিক সংকট দিনকে দিন জটিল হয়ে পড়েছিল। এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে এবং তা নিরসনের উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাতার পর হতে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও বুর্জোয়া শ্রেণি বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান)-এর প্রতি সকল বিষয়ে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। পাকিস্তানের উভয় অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এদেশের বুদ্ধিজীবী মহল বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এর প্রতিবাদে ও সুরাহাকল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিবাদ সভা, আন্দোলন, ধর্মঘট ও অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষিত হবার পর হতে পূর্ব পকিস্তানের জনমনে স্বাধিকার অর্জনের আকাক্সক্ষায় শঙ্কিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র তা বন্ধের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দেয় (সৈয়দ মকসুদ আলী : রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তায় উপমহাদেশ, মাওলা ব্রাদার্স, পৃষ্ঠা ২০২)।
‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’টি মূলত সামরিক শাসক আইয়ুব খান সারা পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর চলমান ছয় দফা কর্মসূচিকে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে করা। বাঙালির মধ্যে যেন স্বাধিকার আন্দোলনের মনোভাব সৃষ্টি না হয়, তাই শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে সামরিক ও বেসামরিক ৩৫ জন ব্যক্তির নামে ১৯৬৮ সালে জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে। অপরদিকে যেন পাকিস্তানিদের ম্যান্ডেট পাওয়া যায়, তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই কৌশল অবলম্বন করেছিল। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামক পাকিস্তানি সামরিকজান্তার করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনে পরিণত হয়। এই মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ঢাকা সেনানিবাসে পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে (ড. সুলতান মাহমুদ ও বিবি মরিয়ম : রাজনীতি ও কূটনীতিকোষ, পৃষ্ঠা ১৮৬)। এই পরিস্থিতিতে সর্বদলীয় ছাত্র পরিষদের ১১ দফা আরো বেগবান হয়ে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়।
‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তিসহ ছাত্রসমাজের ১১ দফা ও ছয় দফার ভিত্তিতে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন, জরুরি আইন প্রত্যাহার প্রভৃতির দাবিতে ১৯৬৯ সালের ছাত্র-জনতা আন্দোলন করে। কিন্তু আইয়ুব খান সামরিক সরকার তা রাষ্ট্রবিরোধী বলে এই আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারি জারি করে। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা সামরিক সরকারের জারিকৃত ১৪৪ ধারাকে অমান্য করে রাস্তায় মিছিল করেছিল। সেই মিছিলে গুলি চালালে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। ছাত্রনেতা আসাদের শহীদ হবার খবরে আন্দোলন গণঅভ্যূত্থানে রূপ নেয়। এর ফলে প্রচ- আন্দোলনের চাপে আইয়ুব খান সরকার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার করে নেয় (ড. সুলতান মাহমুদ ও বিবি মরিয়ম : রাজনীতি ও কূটনীতিকোষ, পৃষ্ঠা ৭২)। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার লক্ষে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০। ছয় দফা ও ছাত্রসমাজের এগরো দফার দাবিতে চলমান গণঅভ্যুত্থানে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসে। এমতাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের সেই চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনকল্পে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক ভাষণে বলেন যে, একটি সাংবাধিানিক সরকার প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা ছাড়া তাঁর আর অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই (মহিউদ্দিন আহমদ : আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০, প্রথমা প্রকাশন, পৃষ্ঠা ২০৩)। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন দেয়ার পেছনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে কু-চক্রান্ত কাজ করছিল। তাদের ধারণা, পাকিস্তানের কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না এবং অন্য দলের সাথে কোয়ালিশন করতে গিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে। এই অজুহাতে পুনরায় সামরিক সরকার ফিরে আসার সম্ভাবনা অধিক। কিন্তু তাদের পূর্বপরিকল্পিত চিন্তায় বাধ সাধে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভাবনীয় জয়ে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি, জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল ৮৮টি এবং অন্যান্য দল ৫৮টি আসন পায়। আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও সরকার গঠন করতে দেয়নি পাকিস্তানি সামরিক সরকার। কারণ বঙ্গবন্ধুর প্রতিজ্ঞা, ক্ষমতায় এলে ছয় দফার ভিত্তিতে সরকার গঠন করা হবে। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও রাজনৈতিক দলের ভেতর সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, পাকিস্তান শাসন করবে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ (মুহম্মদ জাফর ইকবাল : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ০৪)।
কেবল সন্দেহ নয়, তাদের সিদ্ধান্তই ছিল ক্ষমতা হস্তান্তর না করার। এমনই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। ডিসেম্বরের শেষের দিকে যখন তিনি ঢাকায় আসেন, গভর্নমেন্ট হাউজে ভোজপর্ব সেরে ঘরোয়া আলাপচারিতায় ঘোষণা করলেন যে, ‘চিন্তা করো না… এই কালো জারজরা আমাদের শাসন করবে, আমরা তা কোনো দিনই হতে দেব না’। ইয়াহিয়া খানের এমন মন্তব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পৌঁছে গেলেও তিনি অহিংস সমাধানের উদ্দেশ্যে নির্বাচন প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য প্রকাশ্যে ইয়াহিয়া খানকে অভিনন্দন জানালেন। তিনি এও বললেন যে, নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেয়ার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রকারীরা ঢাকায় এসে গোপন সভা করছে। এমনটি হলে বাংলাদেশের মানুষ বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে এই লোকদের মোকাবিলা করবে, এই বলে হুঁশিয়ারি করেন (সিদ্দিক সালিক : উইটনেস টু সারেন্ডার নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, রাবেয়া বুক হাউস, পৃষ্ঠা ৪৮)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাদেশকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র চলছে। তাই তিনি তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তিনি আমার কথা রাখলেন না। রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা’।
১৮ মিনিটের ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালিদের মনে স্বাধিকার আন্দোলনের ঝড় তুলেছিলেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে সার্বিক দিকনির্দেশনা ইঙ্গিত দেন। বাঙালির ন্যায্য অধিকার পেতে যে মুক্তিযুদ্ধের বিকল্প নেয় তারও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

মোহা. মোস্তাক হোসেন : কলাম লেখক ও শিক্ষক, আলীনগর উচ্চ বিদ্যালয়
চাঁপাইনবাবগঞ্জ