আমি লজ্জিত, আহত, কম্পিত: ঋতুপর্ণা
কলকাতার নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে গতকাল সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় ‘রাত দখল’ কর্মসূচি। অন্য সবার মতো তাতে যোগ দিতে গিয়েছিলেন ভারতীয় বাংলা সিনেমার অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। শ্যামবাজারে যাওয়ার পরই তুমুল বিক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। তাকে উদ্দেশ্য করে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দিতে থাকেন আন্দোলনকারীরা; তার গাড়িতেও হামলা চালানো হয়। বিষয়টি নিয়ে জোর চর্চা চলছে। এবার নীরবতা ভাঙলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ভারতীয় একটি গণমাধ্যমে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলেন, ‘আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিহত চিকিৎসক-পড়ুয়ার জন্য সুবিচার চেয়ে ৪ সেপ্টেম্বর শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের প্রতিবাদী জমায়েতে উপস্থিত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এত মানুষের প্রতিবাদ বৃথা যাবে না। আমিও সুবিচারের আশায় রয়েছি। জমায়েতে যোগ দিয়ে মোমবাতি জ্বালাই। কিন্তু, কিছুক্ষণের মধ্যেই চিত্র বদলে গেল। আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভের মুখে পড়লাম। আমার উদ্দেশে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দিতে শুরু করেন। চারপাশ থেকে উলুধ্বনি এবং শঙ্খ বাজিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়। এতেও কিছু মনে করেছি, এমন নয়। কিন্তু তারপর গাড়িতে জুতা ছোড়া হয়। তখন আমি দরজা খুলে বলি আপনারা এমন করবেন না। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতেই এসেছি, বসতে এসেছি। কিন্তু কেউ কোনো কথাই শুনলেন না। আসলে আমার মনে হয়, কিছু মানুষ প্রতিবাদের কথা মাথায় না রেখে, হুজুগে চলে গিয়েছিলেন।’
গতকাল মারাও যেতে পারতেন— এ আশঙ্কা প্রকাশ করে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলেন, ‘বুঝতে পারছি, সকলেই ক্ষুব্ধ। তবে, কলকাতার প্রতিবাদী চেহারার মধ্যে এই চেহারাটা দেখে আমি লজ্জিত, আহত, কম্পিত। বুধবার রাতে আমার প্রাণটাও চলে যেতে পারত। আমি একজন অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে, একজন নারী হিসেবে অন্য নারীর পাশে দাঁড়াতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিরাট সংখ্যক মত্ত এই ঘটনা ঘটায়। আচমকাই একটা জনস্রোত ধাক্কা দিতে শুরু করে। এত চিৎকার হচ্ছিল যে, কারো কোনো কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি তো কাল কোনো তারকা হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে গিয়েছিলাম। যেখানে ঘটনাটা ঘটল, সেখানে নিহত চিকিৎসকের বাবা-মাও এসেছিলেন। ভেবেছিলাম, উনাদের সঙ্গে একবার দেখা করব। বলতাম, উনাদের লড়াইয়ের সঙ্গে আমিও রয়েছি। কিন্তু তা হলো কই!’
এতকিছু ঘটে গেলেও এই প্রতিবাদ থেকে সরে যাবেন না ঋতুপর্ণা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তবে এই ঘটনার পর আমি থেমে যাব, এমন নয়। আমার মনের মধ্যে প্রতিবাদ থাকবে। আমিও একইভাবে সুবিচার চাইব। সেটা থামবে না।’
অপমানিত হলেও তা নিয়ে আক্ষেপ নেই ঋতুপর্ণার। তা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি যে এমন হতে পারে, আমি ভাবিনি। এ তো আমার চেনা কলকাতা। আবেগের, প্রতিবাদের জনসমুদ্র। কিন্তু, বাড়ি ফিরে দেখি গাড়িতে শুধুই আঙুলের ছাপ। শুধু হাত দিয়ে মেরে মেরেই তুবড়ে দিয়েছে গাড়িটা। সত্যি বলছি, আমার তাতে কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, যারা এটা করলেন তারা নিজেরাও জানেন না কী করছেন! সবাই চিৎকার করছিলেন, তারাও চিৎকার করেছেন। একটা বর্বরতার সাক্ষী থাকলাম। ওই রাতে আমি একা তো নই, সোহম-শোলাঙ্কিরাও ছিল। গান গাইছিল ওরা। আমি ওদের সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এমন কিছুর সাক্ষী হব, ভাবতে পারছি না।’
ঋতুপর্ণা জানেন না কেন তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হয়েছে। তা জানিয়েছে তিনি বলেন, ‘বুঝতে পারলাম না কেন এই আক্রোশ। আমি তো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। আমি এই শহরের সকলের সঙ্গে রাত জাগতে গিয়েছিলাম। ওই ভিড়ের মাঝে আমাকে ‘চটিচাটা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এমন অসভ্যতা। আসলে যারা এটা করলেন তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য আন্দোলন নয়। একজন তারকাকে হেনস্তা করা। কাউকে পাচ্ছেন না, সামনে ঋতুপর্ণা ছিল ব্যস, ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমাকে অনেকেই বলেছিলেন জমায়েতে শামিল না হতে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম মানুষ হিসেবে সঙ্গে থাকব। এমন নিকৃষ্ট ঘটনা ঘটল, এখনও ঘোর কাটছে না।’ হামলাকারীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলেন, ‘আমি প্রশ্ন করতে চাই, আমার সমবেদনা জানানো কি অন্যায়? একটি মেয়ের হয়ে তারা আন্দোলন করছেন আর অন্য একজন নারীকেই হেনস্তার শিকার হতে হলো! আসলে হয়তো এই মানসিকতা আমাদের বর্বরতার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।’