আমাদেরও আছে ফুটবলের এক জাদুকর

461

কাল রাত থেকেই অভিনন্দনের বন্যায় ভাসছেন রুবেল মিয়া। নিজের গ্রাম থেকেই বেশি, পরিবারের শুভকামনা তো সব সময়ই থাকে আবাহনীর এই স্ট্রাইকারের সঙ্গে। এলাকার চেয়ারম্যানের ফোনও নাকি পেয়েছেন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানকে আবাহনী হারিয়েছে তাঁরই শেষ মুহূর্তের গোলে। রুবেল বুঝতে পারছেন, অন্য রকম কিছুই করতে পেরেছেন তিনি।
মা ফোন দিয়েছিলেন ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। আজ ভোর হতেই পত্রিকাতে উল্লাসরত ছেলের ছবি দেখে গর্বে ভেসেছেন। আনন্দে উজ্জ্বল হয়েছে তাঁর মুখ। মায়ের আনন্দের কথা বলতে গিয়ে আবাহনী-স্ট্রাইকারের কণ্ঠেও উত্তেজনা। বয়স মাত্র ২২। দোহারা গড়ন। উচ্চতা মেরে-কেটে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। প্রথম দর্শনে ফুটবলার হিসেবে খুব ভরসা করা যায় না। অথচ এই ছোটখাটো খেলোয়াড়ই এখন আবাহনীর সমর্থকদের ভালোবাসার মানুষ। তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে ‘ম্যাজিশিয়ান’ শব্দটি। হ্যাঁ, জাদুকরই বটে, এক বছর ধরে তিনি যা যা করেছেন, প্রতিটিই তো ছাড়িয়ে অন্যটিকে।
কাল সন্ধ্যায় মোহামেডানের বিপক্ষে ম্যাচটা নিশ্চিত ড্র হচ্ছে ধরে নিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের চোখ ধাঁধিয়ে গোল করে আবাহনীকে জিতিয়ে দিলেন রুবেল। সবাই অবাক-বিস্ময়াভিভূত। বদলি সতীর্থ নাবিব নেওয়াজ জীবনের হেড থেকে পাওয়া বলটি না থামতেই দূরের পোস্টে ডান পায়ের নিখুঁত প্লেসিং। রুবেলের কারিশমা এমনই। কখন যে তিনি কী করে বসবেন! আবাহনীর সার্বিয়ান কোচ দ্রাগো মামিচ তো রীতিমতো মজে আছেন রুবেলে, ‘রুবেল প্রতিটি ম্যাচেই নিজের জাত চেনাচ্ছে। কখনো গোল করছে, আবার অন্যকে দিয়ে গোল করাচ্ছে।’
আবাহনীর জার্সি গায়ে দিয়েছেন এই মৌসুমেই। দলকে দুটি ম্যাচে এনে দিয়েছেন মূল্যবান জয়। এই তো গত মে মাসে এএফপি কাপে ভারতের বেঙ্গালুরু এফসির বিপক্ষে প্রায় মাঝমাঠ থেকে এক দূরপাল্লার গোল করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রুবেলের সেই গোল যেভাবে ভাইরাল হয়েছিল, সেটি যদি কেউ না দেখে থাকে, তাহলে তা নির্দিষ্ট ওই ব্যক্তিরই ব্যর্থতা। ইউটিউবে বারবার সার্চ দিয়ে দেখার মতোই গোল। মামিচের মতো অভিজ্ঞ এক কোচ, যিনি আন্তর্জাতিক ফুটবল মিয়ানমার, মালদ্বীপের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনিও মুগ্ধ বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে রুবেলের সেই গোলে, ‘আমি অনেক খেলোয়াড়কে অনেক রকম গোল করতে দেখেছি। কিন্তু রুবেলের গোলটি আমার দেখা সেরা দূরপাল্লার গোল।’ সনদটা কিন্তু কম মূল্যবান নয় রুবেলের এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও রুবেলের দর্শনীয় গোল আছে। ২০১৩ সালে ইরাকে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে শক্তিশালী কুয়েতের বিপক্ষে রুবেলের একমাত্র গোলেই জিতেছিল বাংলাদেশ। ফুটবলের যেকোনো পর্যায়ে কুয়েতের বিপক্ষে এটাই বাংলাদেশের প্রথম জয়।
ঘরোয়া ফুটবলেও করে দেখিয়েছেন কিছু দর্শনীয় গোল। গত মৌসুমে স্বাধীনতা কাপের ফাইনালে আবাহনীর বিপক্ষে চোখধাঁধানো এক বাইসাইকেল কিকের গোলে চট্টগ্রাম আবাহনীকে শিরোপা জিতিয়েছিলেন। সেই গোলটি ভোলেননি সেদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকেরা।
সেই গোল দেখে চট্টগ্রাম আবাহনীর সে সময়ের স্লোভাক কোচ জোশেফ পাবলিক বলেছিলেন, এমন গোল নাকি তিনি কেবল চ্যাম্পিয়নস লিগেই দেখেছেন। এমন গোল বারবার করার সামর্থ্য রুবেলের আছেÑএ কথাও বলেছিলেন সেই কোচ।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের এই ফুটবলারের দর্শনীয় গোল আরও আছে। ২০১৩-১৪ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে খেলার সময় শেখ জামালের বিপক্ষে দূরপাল্লার শটে একটি গোল করেছিলেন। গতি ও স্কিলের সমন্বয়ে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের বোকা বানানোতেও দারুণ তিনি। গত লিগেই এমন দুটি গোল তিনি চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে করেছিলেন মোহামেডানের বিপক্ষে।
রুবেল নিজে অবশ্য গতরাতে মোহামেডানের বিপক্ষে গোলটিকেই সবচেয়ে এগিয়ে রাখতে চান। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর বিপক্ষে মর্যাদার লড়াইয়ে যে গোলে দল জিতেছে, সেটিকে তিনি এগিয়ে রাখবেনÑএটিই স্বাভাবিক। গোলটির গুরুত্বও বড় একটা ব্যাপার।
স্কুল ফুটবলের আবিষ্কার রুবেল। ২০০৯ সালে সিটিসেল স্কুল ফুটবল দিয়ে নিজেকে চিনিয়েছিলেন তিনি। এই প্রতিযোগিতাতেই নিজের নামটি বদলে যায়। হ্যাঁ, রুবেল মিয়া নাকি তাঁর আসল নাম নয়। স্যাররা টুর্নামেন্টের রেজিস্ট্রেশনে নামের শেষে ‘মিয়া’ লিখে দিলে রুবেল হোসেন হয়ে যান রুবেল মিয়া। সেই নামেই এখন পরিচিত। স্কুল ফুটবলে ৪ ম্যাচে ১৪ গোল করেছিলেন। পরের বছর খেললেন অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলে, যুবদলের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রও সফর করেছেন। অনূর্ধ্ব-১৯ দল ঘুরে অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে খেললেন বঙ্গবন্ধু কাপ। জাতীয় দলের জার্সিটাও পেয়ে গেছেন। মালদ্বীপের বিপক্ষে মালেতে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক তাঁর।
মাত্র চার বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন রুবেল। বড় দুই ভাই সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়ে বুঝতে দেননি অভাবের কষ্ট। ফুটবলের বাইরে তাঁর কোনো জীবন নেই। মা, দুই বড় ভাই আর একমাত্র বোনই তাঁর পৃথিবী। বাবার কথা মনে উঠলেই আবেগাক্রান্ত হন, ‘ইশ্! বাবা আমার কোনো সাফল্যই দেখে যেতে পারলেন না।’
এখন তাঁর খেলা দেখতে গ্রামে টিভির সামনে ভিড় জমে। উচ্ছ্বসিত হয়ে সবাই নাকি বলেন, ‘ওই যে দেখ দেখ…আমাদের রুবেল…!’ গ্রামের মানুষের গর্ব আর ভালোবাসাই তাঁর জীবনে অন্যতম বড় পাওয়া। রুবেলের গায়ে এখনো গাইবান্ধার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গন্ধ। গ্রাম থেকে উঠে আসা সেই ছেলেটিই এখন দেশের ফুটবলের নতুন মেগাস্টার। রুবেলকে দেখে এভাবেই উঠে আসুক আরও তারকা। আপাতত রুবেল এগিয়ে যাক আরও বড় স্বপ্ন পূরণের দিকে।